#ভীমবেটকার গুহাচিত্র : গুহামানবের দেশে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর 'ভূপাল রহস্য' উপন্যাসে ক্লাস ফোরে পড়তে প্রথম নাম শুনেছিলাম। কাকাবাবু আর সন্তু পাঁচমারী না গিয়ে গিয়েছিলেন ভীমবেটকায়। অসংখ্য বাঙালি সেই প্রথম এই জায়গার নাম শোনে। কাকাবাবুর উপন্যাসে ভীমবেটকার গা ছমছমে বর্ণনা পড়ে ২০ বছর ধরে ইচছা ছিল আসার। এতদিনে সেই সুযোগ পেলাম। ভারতীয় উপমহাদেশে মনুষ্যপ্রজাতির আদিম, অরণ্যচারী পূর্বসূরীদের প্রথম চিহ্ন পাওয়া যায় মধ্য ভারতের এই পাহাড়ের গুহায়।
১৫.১২.২০১৮।
ভূপাল থেকে একটা গাড়ি বুক করেছিলাম। সকাল ৭ টায় বেরিয়ে প্রথম গন্তব্য ছিল ভোজপুর। পারমার রাজা ভোজের নাম সারা মধ্যপ্রদেশেই খুব শোনা যায়। একাদশ শতকের এই রাজার আমলে ভোজপুরে মন্দির ও প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। আমরা শুধু ভোজেশ্বর শিবমন্দিরটিই দেখলাম। এও এক নির্জন প্রান্তর। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো বড় বড় পাথরের পাশ দিয়ে পৌঁছে গেলাম মাটি থেকে কয়েক মানুষ সমান উঁচু শিবমন্দিরে। পাথরের বড় বড় সিঁড়ি। উপরে একটাই পাথর কেটে বানানো শিবলিঙ্গ, এটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিবলিঙ্গ। খুব সম্ভবত, মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। চারপাশের বিশাল প্রান্তরে ভাঙা পাথরের নানান টুকরো। সকাল ৮টার ঠান্ডা ধু ধু প্রকৃতিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। ভীমবেটকা পৌঁছতে পৌঁছতে আরো এক- দেড় ঘন্টা।
রাস্তায় পড়বে পূরণের সামোসার দোকান। সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। সকালে এইপথের যাত্রীরা অনেকেই এখানে সামোসা গুলাব জামুন খেয়ে থাকেন। সুন্দর স্বাদ। একটু দূরেই বড় শহর ওবাইদুল্লাগঞ্জ। কিছু পরেই সীমানা শুরু হচ্ছে রাতাপানি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের। তারই মধ্যে ভীমবেটকা সহ পাঁচটি পর্বত নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক মানবসভ্যতার আবাসভূমি। পুরাতত্ত্ববিদ ভি.এস.ওয়াকঙ্কার ১৯৫৭ এ প্রথম এই অঞ্চলের গুহায় আদিম মানবের বসবাসের চিহ্নের কথা জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। ৭০ এর দশক থেকে নিরলস গবেষণা চলে। প্রায় ৭৫০ টি প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট গুহা জুড়ে প্যালিওলিথিক, মেসোলিথিক, চালকোলিথিক যুগের মানুষের বসবাস ছিল। এমন গুহাও রয়েছে যেখানে ১ লক্ষ বছর আগের মানুষও থাকত।
স্পেনের আলতামিরা গুহাচিত্রের সঙ্গে তুলনীয় ভীমবেটকার গুহাচিত্র। প্রায় ৩০০০০ বছর আগের থেকে এখানে গুহাচিত্র এঁকেছেন আমাদের পূর্বসূরীরা। সভ্যতা সংস্কৃতির ধারনাই যখন তৈরী হয়নি, তখন কিভাবে এত নিখুঁত ছবি আঁকা হতো, সেটাই আজকের সভ্যতার কাছে একটা বিস্ময়! প্রথম যুগের শিকারজীবী মানুষের ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে পরবর্তীকালের যুদ্ধরত মানুষের চিত্র। চিত্রের বিষয় বৈচিত্র এবং আঁকার মাধ্যমের পরিবর্তন থেকে বিশেষজ্ঞরা ভীমবেটকায় মানবসভ্যতার বিবর্তনের ধারাটি খুঁজে পেয়েছেন। যুগ থেকে যুগান্তরে ভারতীয় উপমহাদেশে মানবসভ্যতার প্রথম আলো হিসাবে ভীমবেটকা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পেয়েছে ২০০৩ সালে।
দর্শকদের মাত্র ১৫ টি গুহা দেখার অনুমতি আছে। বেলেপাথরের বিশাল গুহাগুলির সামনে গা ছমছম করে ওঠে। হাঁ করে থাকা গুহার মুখ থেকে এই বুঝি কেউ বেরিয়ে এল, বা আড়াল থেকে অনেকে বুঝি দেখছে আমাদের, দুর্বোধ্য কোনো ইশারায় ফুঁড়ে দেবে সূচাগ্র পাথরের অস্ত্রে।
অশ্বারোহী, গজারোহী সৈন্যের ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে নৃত্যরত মানুষের ছবি। হাতী, ঘোড়া, হরিণ এর ছবি। পুরাণ বর্ণিত বরাহ অবতারের মতো একটি রক্তবর্ণ অবয়ব আঁকা আছে 'মাশরুম কেভ' এ। আরেকটি আছে 'zoo cave',সেখানে গণ্ডার, সাপ, হরিণ, হাতী,ঘোড়া আরো নানা প্রাণীর ছবি। একটি গুহাতে পাওয়া গেছে একটি শিশুর হাতের চেটোর ছাপ, যা বর্তমান পূর্ণবয়স্ক মানুষের হাতের ছাপের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি!
এই গুহাগুলিও প্রকৃতির একেকটি বিস্ময়। কোন কাল থেকে এইরকম গুহাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কোন আবহবিকারের ফলে পাথর ক্ষয়ে গিয়ে আদিমতম মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। বন্য পশু, ঝড় জল থেকে আগলে রাখত তাদের। সেই মানবেতিহাসের ধাত্রীগৃহে কোনোদিন সত্যি আসতে পারব, ভাবিনি। আসতামও না, এলেও হয়তো সেই আগ্রহ থাকতো না, যদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কাকাবাবুর উপন্যাসে তাঁকে ভীমবেটকার গুহায় রাত্রিবাস করাতেন। যাঁরা লেখাটি পড়ছেন, তাঁরা পারলে ভূপাল রহস্য পড়বেন। বুঝবেন।
চোখের সামনেই বা কতটুকু দেখলাম। নির্ধারিত ১৫ টি গুহার পরেও ভীমবেটকায় প্রায় ২৩০ টি গুহা আছে, যার ১৩৩ টিতে গুহাচিত্র রয়েছে। সেগুলি সাধারণের জন্য নয়। ভীমবেটকা থেকে চলে আসার সময় পিছন থেকে চেয়ে দেখছিল প্রাচীন প্রস্তর যুগের একটা সভ্যতা, তার কয়েক হাজার পরের প্রজন্মকে। কি জানি, কি ধারণা করল আমাদের সম্পর্কে।
ভোপাল থেকে বাস, গাড়ি বা অটো ভাড়া করে ভোজপুর ও ভীমবেটকা দেখে একদিনেই ফিরে আসা যায়।
১০০০-১৫০০ ভাড়া পড়তে পারে। ভীমবেটকায় গাড়ির প্রবেশমূল্য ৩০০। ট্যুরিস্ট বাস হলে ৬০০। এছাড়া জনপ্রতি ২৫ টাকা। গাইড নিলে আলাদা ফি।
ভোপাল থেকে ভীমবেটকা দেখে পাঁচমারী চলে যাওয়া যায়। ভীমবেটকা থেকে পাঁচমারী ৪ ঘন্টার কম লাগবে।
মধ্যপ্রদেশের প্রবল গরমে ভীমবেটকা আসার চাইতে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ঘোরার ভালো সময়।
এটা শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক ইতিহাসের জন্যও অসীম গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত এলাকা। পরিচ্ছন্নতা এবং শান্তি বজায় রাখা আবশ্যক।
যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে "এখানে কি দেখার আছে" জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের জন্য ভীমবেটকা নয়। এর রোমাঞ্চ, গুরুত্ব আলাদা। পুরো মধ্যপ্রদেশটাই অন্যরকম। না সাগর, না পাহাড়, না বরফ। অন্য কিছু। অন্যরকম।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর 'ভূপাল রহস্য' উপন্যাসে ক্লাস ফোরে পড়তে প্রথম নাম শুনেছিলাম। কাকাবাবু আর সন্তু পাঁচমারী না গিয়ে গিয়েছিলেন ভীমবেটকায়। অসংখ্য বাঙালি সেই প্রথম এই জায়গার নাম শোনে। কাকাবাবুর উপন্যাসে ভীমবেটকার গা ছমছমে বর্ণনা পড়ে ২০ বছর ধরে ইচছা ছিল আসার। এতদিনে সেই সুযোগ পেলাম। ভারতীয় উপমহাদেশে মনুষ্যপ্রজাতির আদিম, অরণ্যচারী পূর্বসূরীদের প্রথম চিহ্ন পাওয়া যায় মধ্য ভারতের এই পাহাড়ের গুহায়।
১৫.১২.২০১৮।
রাস্তায় পড়বে পূরণের সামোসার দোকান। সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। সকালে এইপথের যাত্রীরা অনেকেই এখানে সামোসা গুলাব জামুন খেয়ে থাকেন। সুন্দর স্বাদ। একটু দূরেই বড় শহর ওবাইদুল্লাগঞ্জ। কিছু পরেই সীমানা শুরু হচ্ছে রাতাপানি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের। তারই মধ্যে ভীমবেটকা সহ পাঁচটি পর্বত নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক মানবসভ্যতার আবাসভূমি। পুরাতত্ত্ববিদ ভি.এস.ওয়াকঙ্কার ১৯৫৭ এ প্রথম এই অঞ্চলের গুহায় আদিম মানবের বসবাসের চিহ্নের কথা জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। ৭০ এর দশক থেকে নিরলস গবেষণা চলে। প্রায় ৭৫০ টি প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট গুহা জুড়ে প্যালিওলিথিক, মেসোলিথিক, চালকোলিথিক যুগের মানুষের বসবাস ছিল। এমন গুহাও রয়েছে যেখানে ১ লক্ষ বছর আগের মানুষও থাকত।
স্পেনের আলতামিরা গুহাচিত্রের সঙ্গে তুলনীয় ভীমবেটকার গুহাচিত্র। প্রায় ৩০০০০ বছর আগের থেকে এখানে গুহাচিত্র এঁকেছেন আমাদের পূর্বসূরীরা। সভ্যতা সংস্কৃতির ধারনাই যখন তৈরী হয়নি, তখন কিভাবে এত নিখুঁত ছবি আঁকা হতো, সেটাই আজকের সভ্যতার কাছে একটা বিস্ময়! প্রথম যুগের শিকারজীবী মানুষের ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে পরবর্তীকালের যুদ্ধরত মানুষের চিত্র। চিত্রের বিষয় বৈচিত্র এবং আঁকার মাধ্যমের পরিবর্তন থেকে বিশেষজ্ঞরা ভীমবেটকায় মানবসভ্যতার বিবর্তনের ধারাটি খুঁজে পেয়েছেন। যুগ থেকে যুগান্তরে ভারতীয় উপমহাদেশে মানবসভ্যতার প্রথম আলো হিসাবে ভীমবেটকা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পেয়েছে ২০০৩ সালে।
দর্শকদের মাত্র ১৫ টি গুহা দেখার অনুমতি আছে। বেলেপাথরের বিশাল গুহাগুলির সামনে গা ছমছম করে ওঠে। হাঁ করে থাকা গুহার মুখ থেকে এই বুঝি কেউ বেরিয়ে এল, বা আড়াল থেকে অনেকে বুঝি দেখছে আমাদের, দুর্বোধ্য কোনো ইশারায় ফুঁড়ে দেবে সূচাগ্র পাথরের অস্ত্রে।
অশ্বারোহী, গজারোহী সৈন্যের ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে নৃত্যরত মানুষের ছবি। হাতী, ঘোড়া, হরিণ এর ছবি। পুরাণ বর্ণিত বরাহ অবতারের মতো একটি রক্তবর্ণ অবয়ব আঁকা আছে 'মাশরুম কেভ' এ। আরেকটি আছে 'zoo cave',সেখানে গণ্ডার, সাপ, হরিণ, হাতী,ঘোড়া আরো নানা প্রাণীর ছবি। একটি গুহাতে পাওয়া গেছে একটি শিশুর হাতের চেটোর ছাপ, যা বর্তমান পূর্ণবয়স্ক মানুষের হাতের ছাপের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি!
এই গুহাগুলিও প্রকৃতির একেকটি বিস্ময়। কোন কাল থেকে এইরকম গুহাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কোন আবহবিকারের ফলে পাথর ক্ষয়ে গিয়ে আদিমতম মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। বন্য পশু, ঝড় জল থেকে আগলে রাখত তাদের। সেই মানবেতিহাসের ধাত্রীগৃহে কোনোদিন সত্যি আসতে পারব, ভাবিনি। আসতামও না, এলেও হয়তো সেই আগ্রহ থাকতো না, যদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কাকাবাবুর উপন্যাসে তাঁকে ভীমবেটকার গুহায় রাত্রিবাস করাতেন। যাঁরা লেখাটি পড়ছেন, তাঁরা পারলে ভূপাল রহস্য পড়বেন। বুঝবেন।
চোখের সামনেই বা কতটুকু দেখলাম। নির্ধারিত ১৫ টি গুহার পরেও ভীমবেটকায় প্রায় ২৩০ টি গুহা আছে, যার ১৩৩ টিতে গুহাচিত্র রয়েছে। সেগুলি সাধারণের জন্য নয়। ভীমবেটকা থেকে চলে আসার সময় পিছন থেকে চেয়ে দেখছিল প্রাচীন প্রস্তর যুগের একটা সভ্যতা, তার কয়েক হাজার পরের প্রজন্মকে। কি জানি, কি ধারণা করল আমাদের সম্পর্কে।
ভোপাল থেকে বাস, গাড়ি বা অটো ভাড়া করে ভোজপুর ও ভীমবেটকা দেখে একদিনেই ফিরে আসা যায়।
১০০০-১৫০০ ভাড়া পড়তে পারে। ভীমবেটকায় গাড়ির প্রবেশমূল্য ৩০০। ট্যুরিস্ট বাস হলে ৬০০। এছাড়া জনপ্রতি ২৫ টাকা। গাইড নিলে আলাদা ফি।
ভোপাল থেকে ভীমবেটকা দেখে পাঁচমারী চলে যাওয়া যায়। ভীমবেটকা থেকে পাঁচমারী ৪ ঘন্টার কম লাগবে।
মধ্যপ্রদেশের প্রবল গরমে ভীমবেটকা আসার চাইতে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ঘোরার ভালো সময়।
এটা শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক ইতিহাসের জন্যও অসীম গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত এলাকা। পরিচ্ছন্নতা এবং শান্তি বজায় রাখা আবশ্যক।
যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে "এখানে কি দেখার আছে" জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের জন্য ভীমবেটকা নয়। এর রোমাঞ্চ, গুরুত্ব আলাদা। পুরো মধ্যপ্রদেশটাই অন্যরকম। না সাগর, না পাহাড়, না বরফ। অন্য কিছু। অন্যরকম।
বিস্তারিত জানতে উইকিপিডিয়া দেখুন
https://parabaas.com/PB63/LEKHA/bChampakali63.shtml
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjUZe-TtplK1Kst7EUE5sSCTa1E-bI5662_dXmTXexcZtbw_pDgUBIe8vl-ugp8-Sq0bNlQVdnxPLgoswvNqvMqgZpz0bk6YKZrBGtSMpPL3QWhAfSqxItgXsAZ1oPEkx7_HBmWUDzuRdc/s320/IMG_20181215_102857.jpg)
Khub valo laglo pore.
ReplyDeleteThank you
Delete