সাঁচিস্তুপ এবং বিদিশা Sanchi Stupas and Vidisha

               * ইতিহাসের সাঁচি, বিদিশা *
      Historical Sanchi Stupa and Vidisha

         বেরিয়েছি মধ্যপ্রদেশ ঘুরতে। পুরো মধ্যপ্রদেশ তো চারবার ঘুরেও শেষ হবার নয়, তাই এবার দিন পনেরোর ছুটিতে ইন্দোর থেকে শুরু করে উজ্জয়িনী মান্ডু ওমকারেশ্বর হয়ে কালই ভোপাল এসে পৌঁছেছি। আজ সাঁচি যাওয়ার গল্প।
    
         কি আছে সাঁচিতে, সেই তো ক'টা ভাঙাচোরা বাড়িঘর, শিপ্রা এক্সপ্রেসে বসে এক ভদ্রলোক বলেছিলেন। চিরকালই দেখেছি, আমার যা পছন্দ, লোকের তা পোষায় না। সেই বদনাম সঙ্গী করেই আজ দেখলাম সাঁচি স্তুপ, উদয়গিরি, বিজামন্ডল আর হেলিওডোরাস পিলার।

      বেরিয়েছিলাম ভোপাল থেকে বাস ধরতে, কিন্তু বেড়াতে এসে বাস চাপতে আর ইচ্ছে করলনা, তাই অটোর সঙ্গে দরাদরি শুরু করলাম। শেষকালে ইরফান ভাই ১২০০ টাকায় সাঁচি, উদয়গিরি, বিদিশা নিয়ে যাবে বলল। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে ভোপাল-বিদিশা রোড ধরে সাঁচির দিকে চললাম।

        ঘন দাড়ি, চোখে সুর্মা পরা ইরফান ভাই প্রায় কথাই বলেনা। চলতে শুরু করার প্রায় এক ঘন্টা পর প্রথম কথা বলেছিল, কর্ক রেখা দেখনা হ্যায়? আমি কর্ক বুঝিনা। কেয়া কেয়া করতে করতেই দেখি ঘ্যাঁচ করে রাস্তার ধারে একটা বোর্ডের পাশে অটো দাঁড়িয়ে গেল। রাস্তার দুপাশে দুটো প্রস্তরফলক রাস্তার দৈর্ঘ্যের সাথে তীর্যক ভাবে টানা দুটো সমান্তরাল সরলরেখার দ্বারা যুক্ত হয়েছে। ফলকের ওপর লেখা ট্রপিক অফ ক্যানসার। পশ্চিমবঙ্গেও আছে, কিন্তু আমি এই প্রথম দেখলাম কর্কটক্রান্তি রেখা।


        সাঁচিতে ঢোকার খানিক পরেই ডানদিকে অনেক উঁচুতে ছোট্ট করে উঁকি দেয় বিশ্ববিখ্যাত বৌদ্ধস্তুপ। ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়, গাড়ি বা অটো সোজা উঠে যায় গেটের সামনে। চোখের সামনেই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। সেই সুপ্রাচীনের সামনে মুখের কথা সরেনা, না সরাই ভালো।

        প্রথমেই চৈত্যগিরি মন্দির, মহাবোধি সোসাইটির এই মন্দিরে রয়েছে সারিপুত্ত ও মোদগলায়নের অস্থি অবশেষ। লন্ডন থেকে প্রথমে ১৯৪৭ সালে শ্রীলঙ্কায়,পরে ১৯৫২ সালে ভারতে নিয়ে আসা এই অস্থি ভারতে বৌদ্ধধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে বলে মনে করা হয়। বর্তমানে এটি একটি মিউজিয়াম।
                             মহাবোধি চৈত্য

         আর অসংখ্য ছবিতে, টাকার গায়ে আমরা যা দেখি, সেই খ্রী:পূর্ব ২য় শতকের সম্রাট অশোক নির্মিত সাঁচিস্তুপ আজও ২৩০০ বছরের ইতিহাস নিয়ে মৌনমুখর। মৌর্য থেকে শুরু, তারপর সুঙ্গ রাজাদের সময়ে দ্বিতলে ওঠার সিঁড়ি, তোরণ ও স্তম্ভগুলি, সাতবাহন রাজাদের সময়ে প্রবেশদ্বারগুলির কারুকার্য- এইভাবে নানা সময়ে নানা সংস্কৃতির প্রভাবে আজকের আকার নিয়েছে ভগবান বুদ্ধের অস্থির ওপর নির্মিত ইঁটের নিরেট অর্ধগোলক সাঁচিস্তুপ। তোরণের গায়ে রয়েছে বুদ্ধের জীবনের গুরুত্বপূর্ন ঘটনাসমূহ। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাঁর অস্থির অধিকার নিয়ে বিরোধ চলছিল মল্ল ও কুশীনগরের মধ্যে। সেই ঘটনাও ছবি হয়ে আছে তোরণের গায়ে। গ্রীক প্রভাবিত গান্ধার শিল্পকলার ছাপ মূর্তিগুলিতে। ব্রাহ্মী লিপিতে কত কি লেখা, গাইড কিছু কিছু বলেছিলেন, কিন্তু মনে নেই এখন। আমার বরাবরের ধারণা ছিল, স্তুপের মধ্যে বুঝি ঢোকা যায় মন্দিরের মতো, কিন্তু দেখলাম পুরোটাই নিরেট। কোনো দরজা নেই। অশোকের তৈরী স্তুপ ছিল এর অর্ধেক আয়তনের প্রায়, পরে সুঙ্গযুগে স্তূপটিকে পাথর দিয়ে আবৃত করা হয়। বর্তমানে সেটিই দেখি আমরা।
বিশ্ববিখ্যাত সাঁচিস্তুপ

স্তুপের একটি তোরণ।


       একইরকম কিন্তু ছোট কতকগুলি স্তুপ রয়েছে আশেপাশে। এগুলি বুদ্ধের শিষ্য বা সাঁচিতে পাঠরত ভিক্ষুদের স্মৃতিতে নির্মিত। একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মনেস্ট্রি, তার অনেকগুলি প্রকোষ্ঠ, সেগুলি বুঝি ভিক্ষুদের ধ্যান বা অধ্যয়নের জন্য ছিল এককালে। তারই পিছনে একটি বিশাল ইঁটের বাটির মতো পাত্র, মাধুকরীতে পাওয়া শস্য সেখানে এনে জমা করা হত।
প্রাচীন বৌদ্ধভিক্ষুদের শস্যাধার

একটি বড় জলাধারও ছিল। এছাড়াও বেশ কিছু প্রাচীন মন্দির রয়েছে, গুপ্তযুগ থেকে প্রায় একাদশ শতক অবধি চলেছিল সাঁচিস্তুপের আশপাশের অজস্র নির্মাণ, তারপর কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া।


        ১৮১৮। জেনারেল হেনরি টেলর প্রথম এই পরিত্যক্ত স্তুপটির কথা উল্লেখ করেন। তারপর ইতস্তত কিছু অনুসন্ধান চললেও স্যার জন মার্শাল (সবার জানা নাম, হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, সারনাথের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের প্রধান) ১৯২০ সালের মধ্যে এই যুগান্তকারী ঐতিহাসিক কীর্তিটি পুনর্জীবিত করেন। ১৯৮৯ এ UNESCO সাঁচিস্তুপকে World Heritage Site এর স্বীকৃতি দেয়।


          কীসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভাবলে গা শিরশির করে এখনো। অনেকটাই সময় নিয়েছিলাম ওখানে, বাইরে আসতে দেখি ইরফান ভাই কেমন উসখুস করছে। আসলে সেদিন ছিল শুক্রবার, ওর নামাজের দিন। বেলা ২.১৫ বেজে গেলে নামাজ পড়া হবেনা ওর। এবার একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। হ্যাঁ, চ্যালেঞ্জই বলা যায়। এই পুরাতত্ত্বের দেশে মসজিদ পাওয়া মুশকিল। এদিকে আমরা উদয়গিরি হয়ে বিদিশা চলেছি। সহায় হলো গুগল ম্যাপ। উদয়গিরি যখন পৌঁছলাম তখন ১.২০ দুপুর। এখন বিদিশা যেতে ১৫ মিনিট লাগবে। সেখানে মসজিদ আছে। গুপ্তযুগের সমসাময়িক উনিশটি হিন্দু ও একটি জৈন গুহা নিয়ে উদয়গিরি। মোটামুটি পঞ্চম শতকের গুহাগুলির মধ্যেকার ভাস্কর্য আর নির্জন অনতিউচ্চ পাহাড়ের মধ্যে মধ্যে রহস্যময় গুহাগুলির আদিম গম্ভীর আহ্বানই উদয়গিরির মূল আকর্ষণ। কিন্তু ইরফান ভাইকে নামাজ পড়াতে না পারলে আমাদেরও মন খুঁতখুঁত করছে। তাই মিনিট ১০ থেকেই পাহাড় থেকে নেমে পড়লাম। আবার গুগল ম্যাপ দেখে চলা। বেতোয়া নদী পেরিয়ে গেল। ইরফানকে মসজিদের গলিতে পৌঁছানোর রাস্তা দেখিয়ে দিলাম ম্যাপ থেকে। সেখানে পৌঁছে তার মুখে হাসি ফুটল। তারপর আমাদের বিজামন্ডলের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল নামাজ পড়তে। আমরাও শান্তি পেলাম।

বিজামন্ডল এর দুটি ছবি


       বিজামন্ডল হলো একাদশ শতকে পারমার রাজা নরবর্মণের সময়কার একটি মন্দির। মন্দিরের আশপাশে ছড়ানো অবস্থায় আজও পড়ে আছে স্থাপত্যের নানান নিদর্শন। মন্দিরটি সম্ভবত অসমাপ্ত অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছিল। একটি বাউলি আছে পাশে। আর সামনের দিকে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের স্টোররুম। মন্দিরের বাগানটির দেখাশোনা করছে সদ্য চাকরি পাওয়া গার্ডেন ইনচার্জ, উত্তরপ্রদেশের ছেলে। যথারীতি কেন্দ্রের একের পর এক পরীক্ষা বাতিল হওয়া নিয়ে তিতিবিরক্ত। এখানে ফাঁকা মন্দিরে প্রচুর সময় পায়। বসে বসে পড়ে। সেই বলল, হেলিওডোরাস পিলার দেখে আসুন। আমি নেটে দেখেছিলাম। ভালো বুঝিনি। ছেলেটির কথায় বুঝলাম ব্যাপারটা।

      উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্যাকট্রিয়ান রাজাদের রাজত্বকালে অনেক গ্রীক রাজপুরুষ বা কর্মচারী ভারতীয় সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট ও অঙ্গীভূত হয়ে পড়েন। সেইরকমই একজন ছিলেন হেলিওডোরাস, ইন্দো-গ্রীক রাজা আন্টিয়ালসিডসের দূত। সুঙ্গ রাজা ভগভদ্রের সভায় দূত হিসাবে আসেন। বাসুদেব মন্দিরের সামনে তিনি এই গরুড় স্তম্ভটি ১১০ খ্রিস্টপূর্বব্দে নির্মাণ করেন। হেলিওডোরাস বিষ্ণুর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, নিজেকে ভাগবত বলে পরিচয় দিতেন। এখন এই পিলারটি খাম্বা বাবা নামে পরিচিত। মূলতঃ মৎস্যজীবীরা এর উপাসনা করেন

হেলিওডোরাস পিলার

ব্রাহ্মী হরফে পালি ভাষায় উৎকীর্ণ লিপি। হেলিওডোরাস পিলারের গায়ে।

       ইরফান ভাই ফেরার পথে বড় দিলখোলা হয়ে উঠেছে। অনেকেই কথা বলছিল। আমাদেরও ভালো লাগছিলো, কোথায় না গিয়েছিলাম- কতকালের ইতিহাসের সামনে! কত ক্ষুদ্র আমরা, কত প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে কত সভ্যতা লীন হয়ে গেল, আর আমরা? শহরে মলের পর মল বানিয়ে ক্রেতা বিক্রেতা উপভোক্তা হয়েই বেঁচে রইলাম। এই সাঁচিতেই বিদিশার কন্যা দেবীর সঙ্গে অশোকের বিবাহ, আজকের দৈনন্দিন রোজনামচায়  ধুলোময় সাঁচি আর বিদিশাকে দেখলে কে বলবে!

        বিকাল পড়ে আসছে। ভারতেতিহাসের ধাত্রীভূমিতে পাঠানোর জন্য অদৃষ্টকে ধন্যবাদ।

কিভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে শিপ্রা এক্সপ্রেস ধরে                                ভোপাল নেমে রাত্রিবাস করুন।
                        পরদিন বাস বা অটো ধরে সাঁচি
                        বিদিশা ঘুরে নেওয়া যায়।
                        ইন্দোর থেকে ট্রেনে ভোপাল আসা                                যায়।
কোথায় থাকবেন: প্রচুর হোটেল রয়েছে ভোপাল                                      স্টেশনের কাছে। আগে থেকে বুক                                করার দরকার নেই।
কি খাবেন: মূলতঃ নিরামিষ খাবার মিলবে। তবে বেশ                    কিছু ভালো রেস্টুরেন্ট রয়েছে ভোপালে।                      আমিষ পাবেন। বিদিশার বিজামন্ডলের                        কাছে হোটেল রয়াল প্যালেস খাবার জন্য                     ভালো।

                        –ঋত্বিক

No comments:

Post a Comment

Write your comment here

Kinnaur Calls... A Trip to Kinnaur

       A trip to Kinnaur, Himachal Pradesh, India Kinnaur at its best...View at Sangla                   A click on this video ...

Popular posts